এসি রুমে বসেও ঘামতে লাগলো মুশফিক। প্রশ্ন করা হয়েছে, কিন্তু উত্তর যেন ঠিক খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর সামনে বসা ব্যক্তি জানতে চান, “২০২৫ সালে লাভজনক অনলাইন কোর্স কীভাবে তৈরি করবেন?”
ডিজিটাল মার্কেটার পজিসনে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে এসেছে মুশফিক একটি বড় বিজ্ঞাপন সংস্থায়।
কন্টেন্ট রাইটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, ফানেল মার্কেটিং এমন অনেক বিষয়ে পড়াশোনা করেও মুশফিকের মন যেন অস্থির। হঠাৎই তাঁর মনে পড়ল প্রলয় হাসানের কোর্সটির কথা, যা থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছিলেন।
একটু থেমে মুশফিক বললেন, “লাভজনক অনলাইন কোর্স তৈরি করতে দরকার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, লক্ষ্যভিত্তিক কন্টেন্ট, কার্যকর বিপণন এবং শিক্ষার্থীদের চাহিদার প্রতি নজর দেওয়া। অনলাইনে শিক্ষা বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে এমন কোর্স তৈরি করতে হবে যা শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যবান ও প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম।”
এবার প্রশ্নকর্তা জানতে চাইলেন, “তারপর?”
মুশফিক ভাবল, আরেকটু বিস্তারিত বলা যাক:
“লাভজনক অনলাইন কোর্স তৈরি করতে কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হবে।”
১. কোর্সের বিষয়বস্তু নির্ধারণ
লাভজনক অনলাইন কোর্স তৈরি করতে প্রথমেই সঠিক একটি বিষয় নির্বাচন করা জরুরি, যেখানে আপনার দক্ষতা রয়েছে এবং বাজারে যার চাহিদা রয়েছে। বিষয়বস্তু চিহ্নিত করার জন্য যে ধাপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে তা হলো:
চাহিদা বিশ্লেষণ: বর্তমান সময়ে মানুষের আগ্রহ ও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নির্ধারণ করতে হবে। গুগল ট্রেন্ডস, আন্সার দ্য পাবলিক এবং উবার সাজেস্টের মতো টুল ব্যবহার করে জনপ্রিয় কীওয়ার্ড ও ট্রেন্ডিং বিষয়গুলো খুঁজে বের করা। কোন কোন ক্ষেত্রে বাজারে ঘাটতি রয়েছে এবং কীভাবে সেই ঘাটতি পূরণ করা যায়, সেগুলো বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ ।
নির্দিষ্ট নীশ নির্বাচন: লাভজনক কোর্সের জন্য নির্দিষ্ট নীশ নির্বাচন করলে শিক্ষার্থীদের কাছে তা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, সাধারণ “মার্কেটিং বেসিকস” কোর্সের পরিবর্তে, “রিয়েল এস্টেট এজেন্টদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং” এর মতো নির্দিষ্ট ও লক্ষ্যযুক্ত বিষয়গুলো ভালো সাড়া পেতে পারে।
বিষয়ের যাচাই:সম্ভাব্য বিষয়ের চারপাশে আগ্রহের মাত্রা যাচাই করতে ফোরাম ও সামাজিক মাধ্যমে যাচাই করে দেখা যায় । আলোচনায় বিষয়টি জনপ্রিয় হলে বিভিন্ন প্রশ্ন বা মন্তব্য পাওয়া যাবে। এছাড়া লক্ষ্যমাত্রা দর্শকদের ছোট একটি জরিপের মাধ্যমেও বিষয়টির চাহিদা যাচাই করতে পারেন।
“এরপর কী করতে হবে?” প্রশ্নকর্তা জানতে চাইলে মুশফিক মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল যে প্রলয় হাসানের কোর্সটি ভালভাবে করেছিল, উনি এই বিষয়গুলো তাকে বিশদভাবে বুঝিয়েছিলেন।
২. কোর্সের কাঠামো নির্ধারণ
পরবর্তী ধাপ হলো কোর্সের কাঠামো তৈরি করা, যা শিক্ষার্থীদের কাছে কোর্সটি আরও আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করে তোলে।
কোর্সের উদ্দেশ্য নির্ধারণ:শিক্ষার্থীরা কোর্স শেষে কী দক্ষতা অর্জন করবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এই লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্সটির গুরুত্ব বোঝাতে সহায়তা করে এবং তাদের প্রেরণা যোগায়।
মডিউলে কন্টেন্ট বিভাজন:কোর্সটি বিভিন্ন মডিউলে ভাগ করা উচিত, যাতে প্রতিটি মডিউল একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর ফোকাস করে। মডিউলগুলো যেন একে অপরের পরিপূরক হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা ক্রমান্বয়ে বিষয়গুলো সহজে আয়ত্ত করতে পারে।
অ্যাসাইনমেন্ট নির্ধারণ: শিক্ষার্থীদের শেখা শক্তিশালী করতে প্রতিটি মডিউলের শেষে অ্যাসাইনমেন্ট বা কুইজ রাখা যেতে পারে । এই ধরনের ইন্টারেক্টিভ উপকরণ শেখার প্রক্রিয়াকে আরও মজবুত ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
সময়সীমা নির্ধারণ: কোর্সের বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে সময়সীমা নির্ধারণ করুন। যদি এটি প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য হয়, তাহলে তা সংক্ষিপ্ত রাখার চেষ্টা করুন, যেন শিক্ষার্থীরা তা সহজে শেষ করতে পারে এবং শেখার প্রক্রিয়ায় উদ্বেগ অনুভব না করে।
৩. আকর্ষণীয় এবং উচ্চ মানসম্পন্ন কন্টেন্ট তৈরি করা
কোর্সটি সফল করার জন্য কন্টেন্টটি অবশ্যই মানসম্পন্ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় হতে হবে। এতে ভিডিও, অডিও এবং লিখিত উপকরণসহ বিভিন্ন ধরণের মিডিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে।
মানসম্মত ভিডিও প্রস্তুত করা:ভিডিও অনলাইন শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হওয়ায় এর গুণমান নিশ্চিত করা জরুরি। অডিও মান ভালো হওয়া, পর্যাপ্ত আলো এবং দৃশ্যমানতা শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সহায়ক হয়।
ভিজ্যুয়াল এবং গ্রাফিক্স ব্যবহার:স্লাইড, ইনফোগ্রাফিক ও অ্যানিমেশনের মতো ভিজ্যুয়াল টুল জটিল বিষয়গুলো সহজ করে উপস্থাপন করতে সহায়তা করে। এগুলিকে অবশ্যই স্পষ্ট ও প্রাসঙ্গিক হতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝতে পারে।
বাস্তব উদাহরণ সংযোজন: বাস্তব উদাহরণ যেমন কেস স্টাডি ও বাস্তব পরিস্থিতির মডেল কন্টেন্টটিকে আরও আকর্ষণীয় ও প্রয়োগযোগ্য করে তোলে। এটি শিক্ষার্থীদের শেখা বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে।
কুইজ ও মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করা: প্রতিটি মডিউলের শেষে কুইজ বা মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ ধরে রাখতে এবং তাদের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে সহায়তা করে।
প্রশ্নকর্তা মুশফিককে জিজ্ঞাসা করল, “এতেই কি লাভজনক হবে?”
মুশফিক খানিকক্ষণ চিন্তা করল। ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। মুশফিক আবার বলা শুরু করল,
৪. কোর্সের জন্য সঠিক প্ল্যাটফর্ম নির্বাচন করা
কোর্সটি কোথায় হোস্ট করা হবে, সেটি এর লাভজনকতার উপর বড় প্রভাব ফেলে। ইউডেমি এবং টিচেবলের মতো জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো কোর্স তৈরি ও বিপণনকে সহজ করে তোলে।
নিজের ওয়েবসাইটে হোস্ট করা:নিজের ওয়েবসাইটে কোর্স হোস্ট করা উত্তম, কারণ এতে নিজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। ইউডেমি ও টিচেবলের মতো প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীরা সহজেই কোর্স খুঁজে পায়, তবে এতে প্ল্যাটফর্ম ফি কেটে নেওয়া হয়। নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে নিজের ওয়েবসাইট ব্যবহার করা যেতে পারে।
মার্কেটপ্লেসের বৈশিষ্ট্য যাচাই: যে মার্কেটপ্লেসগুলো আপসেল, মূল্য নির্ধারণের বিভিন্ন স্তর এবং কুপন কোডের মতো টুল প্রদান করে, তা লাভ বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
৫. কোর্সের মূল্য নির্ধারণ করা
অনলাইন কোর্সের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করা এর লাভজনকতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সাধারণ কিছু মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতিগুলো হল:
এককালীন পেমেন্ট:কোর্সের সম্পূর্ণ অ্যাক্সেসের জন্য এককালীন ফি নির্ধারণ করা যেতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ এবং সরাসরি পদ্ধতি।
সাবস্ক্রিপশন মডেল:ধারাবাহিক বা অতিরিক্ত সুবিধা (যেমন মাসিক Q&A সেশন) দেওয়া হলে, সাবস্ক্রিপশন মডেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে প্রতি মাসে আয়ের সম্ভাবনা থাকে, তবে নিয়মিত কন্টেন্ট সরবরাহ করতে হবে।
বাজেট বিবেচনা: প্রতিযোগীদের মূল্য যাচাই করে দেখা এবং শিক্ষার্থীদের বাজেট বিবেচনায় প্রতিযোগীদের তুলনায় কম মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৬. কোর্সটি কার্যকরভাবে মার্কেটিং করা
কোর্স সম্পর্কে মানুষ না জানলে সেরা কোর্সও জনপ্রিয় হবে না, তাই একটি কার্যকর বিপণন কৌশল অপরিহার্য।
সামাজিক মাধ্যমে প্রচার:ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের কাছে কোর্সটি পৌঁছানো সম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট শেয়ার করা, প্রশংসাপত্র প্রকাশ এবং লাইভ সেশনের মাধ্যমে আগ্রহ তৈরি করা যেতে পারে।
ইমেইল মার্কেটিং:একটি ইমেইল তালিকা তৈরি করে সম্ভাব্য শিক্ষার্থীদের কাছে কোর্সটি পৌঁছানো এবং প্রচার করা যেতে পারে। এটি একটি প্রভাবশালী মাধ্যম।
কন্টেন্ট মার্কেটিং: ব্লগ লেখা, ইউটিউব ভিডিও তৈরি করা, বা অতিথি পোস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে কন্টেন্টের মাধ্যমে পৌঁছানো সম্ভব।
ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে প্রচার: প্রয়োজনে ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে কাজ করে লাভের একটি অংশ শেয়ার করে কোর্সটি আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়।
বিজ্ঞাপন: গুগল এবং ফেসবুকে পেইড বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে কোর্সের ব্যাপারে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
৭. ফিডব্যাক সংগ্রহ এবং পুনর্বিবেচনা করা
কোর্সের ধারাবাহিক উন্নতি এবং লাভজনকতা বজায় রাখতে ফিডব্যাক সংগ্রহ অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের মতামত সংগ্রহ করে তা থেকে শেখা এবং সেই অনুযায়ী কোর্সে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা উচিত।
২০২৫ সালে অনলাইন কোর্সের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা লাভজনক কোর্স তৈরির জন্য একটি বড় সুযোগ এনে দিবে।
“আশা করি আমি প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দিতে পেরেছি।”
“অসাধারণ, আপনি প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। কত বেতন চান আপনি?” প্রশ্নকর্তা মুশফিককে বললেন।
মুশফিক তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে উত্তর দিল, “বেতন আমার প্রধান লক্ষ্য নয়। আমি এখন কাজ শিখতে চাই।”
“আগামী মাসের ১ তারিখে এপয়েন্টমেন্ট লেটার ইমেইলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে,” প্রশ্নকর্তা মুশফিককে জানালেন।