টয়োটা প্রডাকশন সিস্টেম (TPS): বাংলাদেশের কারখানায় প্রয়োগের স্টেপ বাই স্টেপ গাইড

আজ আমরা জানবো বিশ্বের সবচেয়ে সফল উৎপাদন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি — টয়োটা প্রোডাকশন সিস্টেম (TPS)-এর গোপন রহস্য। জাপানের টয়োটা মোটর কর্পোরেশন থেকে উদ্ভূত এই পদ্ধতিটি আজ শুধু গাড়ি উৎপাদনেই নয়, বিশ্বজুড়ে প্রতিটি শিল্পক্ষেত্রে “লিন ম্যানুফ্যাকচারিং”-এর গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে স্বীকৃত!

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে TPS কিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব? কীভাবে এই পদ্ধতি আপনার উৎপাদন খরচ ৫০% পর্যন্ত কমিয়ে, পণ্যের গুণগত মান ও উৎপাদন গতি বাড়াতে পারে? চলুন, স্টেপ বাই স্টেপ শিখে নিই কিভাবে JIT (জাস্ট-ইন-টাইম), জিদোকা, এবং কাইজেনের মতো টুলস ব্যবহার করে আপনার কারখানাকে রূপান্তরিত করবেন!

TPS-এর মূল দর্শন

টয়োটা প্রডাকশন সিস্টেম দুটি মূল স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে:

  1. জাস্ট-ইন-টাইম (JIT) – প্রয়োজন অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় পরিমাণে, প্রয়োজনীয় সময়ে উত্পাদন
  2. জিদোকা (Jidoka) – স্বয়ংক্রিয় ত্রুটি সনাক্তকরণ ও সমাধান

এই দুটি ধারণা একসাথে অপচয় কমাতে এবং সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। টয়োটা এই পদ্ধতিকে একটি “ঘরের” মতো কল্পনা করে যার ছাদ হল গুণমান, দেয়াল হল JIT এবং জিদোকা, আর ভিত্তি হল নিরন্তর উন্নয়ন বা কাইজেন।

বাংলাদেশের কারখানায় TPS বাস্তবায়নের ধাপসমূহ

ধাপ ১: মূল্যায়ন ও পরিকল্পনা

প্রথমেই আপনার কারখানার বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করতে হবে। এর জন্য:

  • কাজের প্রবাহ চিত্রিত করুন – কাঁচামাল প্রবেশ থেকে শুরু করে শেষ পণ্য বের হওয়া পর্যন্ত
  • অপচয় সনাক্ত করুন – যেমন: অতিরিক্ত উৎপাদন, অনাবশ্যক পরিবহন, মজুদ
  • সহকর্মীদের মতামত নিন – তারাই প্রতিদিন কাজ করেন, তাদের পরামর্শ মূল্যবান

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টস কারখানায় দেখা গেছে যে কাপড় কাটার পর থেকে সেলাই শেষ হওয়া পর্যন্ত অনেক সময় নষ্ট হয় এবং বড় পরিমাণে অর্ধ-সমাপ্ত পণ্য জমা হয়ে থাকে। এটি একটি পরিষ্কার অপচয় যা TPS দিয়ে সমাধান করা যাবে।

ধাপ ২: 5S পদ্ধতি বাস্তবায়ন

টয়োটা প্রডাকশন সিস্টেমের প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ হল 5S পদ্ধতি বাস্তবায়ন। এগুলো হল:

  1. সেইরি (Seiri) – সাজানো: প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস আলাদা করা
  2. সেইতন (Seiton) – গুছানো: সবকিছু সঠিক জায়গায় রাখা
  3. সেইসো (Seiso) – পরিষ্কার করা: কর্মস্থল পরিচ্ছন্ন রাখা
  4. সেইকেৎসু (Seiketsu) – মানসম্মত করা: প্রথম তিনটি ‘S’ নিয়মিত পালন করা
  5. শিৎসুকে (Shitsuke) – অভ্যাস করা: 5S কে দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, কোন জায়গায় কোন জিনিস রাখা হবে তা পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করুন। যেমন: সুতা, বোতাম, জিপার ইত্যাদির জন্য আলাদা আলাদা রঙের বাক্স ব্যবহার করুন এবং সেগুলো সেলাই মেশিনের কাছাকাছি রাখুন।

ধাপ ৩: ভিজ্যুয়াল ম্যানেজমেন্ট

কারখানার সকল কর্মীর জন্য তথ্য দৃশ্যমান করুন:

  • উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জন দেখানোর জন্য বড় ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করুন
  • রঙ-কোডেড সিগনাল ব্যবহার করুন (কানবান কার্ড)
  • প্রতিটি কাজের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ওয়ার্ক সীট তৈরি করুন

আমাদের এক বাংলাদেশী পোশাক কারখানায় দেখা গেছে যে কর্মীরা আজকের টার্গেট এবং কতটুকু পণ্য উৎপাদিত হয়েছে তা আগে জানতেন না। একটি ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করার পর, সবাই লক্ষ্যমাত্রা বুঝতে পারল এবং তাদের কাজের গতি বাড়ল।

ধাপ ৪: জাস্ট-ইন-টাইম (JIT) বাস্তবায়ন

JIT বাস্তবায়নের জন্য:

  • কানবান সিস্টেম চালু করুন – এটি একটি ভিজ্যুয়াল সিগনাল ব্যবস্থা যা দেখায় কখন কী পরিমাণ উৎপাদন করতে হবে
  • ব্যাচ সাইজ কমান – ছোট ব্যাচে উৎপাদন করলে নমনীয়তা বাড়ে
  • সাপ্লায়ার পার্টনারশিপ গড়ে তুলুন – সময়মত কাঁচামাল সরবরাহের জন্য

ধরুন, আপনার টি-শার্ট কারখানায় এক সপ্তাহের জন্য কাপড় স্টক করে রাখতেন। JIT বাস্তবায়নের পর, আপনি মাত্র 1-2 দিনের কাপড় রাখছেন এবং সাপ্লায়ার দিনে দু’বার ডেলিভারি দিচ্ছে। এতে আপনার স্টোরেজ খরচ কমে গেছে এবং নগদ প্রবাহ উন্নত হয়েছে।

ধাপ ৫: জিদোকা (Jidoka) বাস্তবায়ন

জিদোকা হল ত্রুটি সনাক্তকরণ ও সমাধান। এর জন্য:

  • অ্যানডন সিস্টেম স্থাপন করুন – সমস্যা দেখা দিলে উৎপাদন লাইন বন্ধ করার ব্যবস্থা
  • ত্রুটি-প্রুফিং টেকনিক (পোকা-যোকে) ব্যবহার করুন – যন্ত্রপাতি এমনভাবে ডিজাইন করুন যাতে ভুল হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়
  • স্বয়ংক্রিয় ত্রুটি সনাক্তকরণ সিস্টেম স্থাপন করুন

বাংলাদেশের একটি জুতা কারখানায় “অ্যানডন” সিস্টেম চালু করা হয়েছে। যখনই কোন কর্মী পণ্যে ত্রুটি দেখতে পান, তিনি একটি লাল বাতি জ্বালাতে পারেন এবং উৎপাদন লাইন বন্ধ হয়ে যায়। এটি বড় ত্রুটি সমস্যা হওয়ার আগেই সমাধান করতে সাহায্য করে।

ধাপ ৬: কাইজেন (Kaizen) – নিরন্তর উন্নয়ন

TPS-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল নিরন্তর উন্নয়ন বা কাইজেন:

  • নিয়মিত কাইজেন মিটিং আয়োজন করুন
  • সমস্যা সমাধানে PDCA (Plan-Do-Check-Act) চক্র ব্যবহার করুন
  • কর্মীদের উদ্ভাবনী ধারণা উত্সাহিত করুন

একটি বাংলাদেশী লেদার গুডস কারখানায় কাইজেন টিম গঠন করা হয়েছিল। প্রতি সপ্তাহে তারা কর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশগুলি নিয়ে আলোচনা করত। এক কর্মী পরামর্শ দিয়েছিলেন যে কাটিং টেবিলের লেআউট পরিবর্তন করলে অপচয় কমবে। তার পরামর্শ বাস্তবায়নের পর, উৎপাদনশীলতা 15% বেড়ে গেল!

ধাপ ৭: স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন

সেরা অনুশীলনগুলো মানসম্মত করা:

  • প্রতিটি কাজের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (SOP) তৈরি করুন
  • কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিন
  • অডিট পদ্ধতি স্থাপন করুন

চট্টগ্রামের একটি ইলেকট্রনিক্স কারখানায় সব কাজের জন্য SOP তৈরি করা হয়েছে। নতুন কর্মী আসলে তাকে শুধু SOP অনুসরণ করতে শেখানো হয়, যা প্রশিক্ষণ সময় কমিয়ে দিয়েছে এবং ত্রুটি 30% কমিয়েছে।

বাংলাদেশের কারখানায় TPS বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

চ্যালেঞ্জ ১: সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিরোধ

কর্মীদের মনোভাব পরিবর্তন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর সমাধান:

  • পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ও সুবিধা ব্যাখ্যা করুন
  • সফলতার ছোট ছোট উদাহরণ দেখান
  • কর্মীদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করুন
  • সফলতা উদযাপন করুন

চ্যালেঞ্জ ২: প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা

অনেক কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি নেই। এর সমাধান:

  • ধাপে ধাপে প্রযুক্তি আপগ্রেড করুন
  • কম খরচের সমাধান দিয়ে শুরু করুন
  • ‘বাংলাদেশীকরণ’ করুন – স্থানীয় প্রেক্ষাপটে অভিযোজিত করুন

চ্যালেঞ্জ ৩: সাপ্লাই চেইন জটিলতা

বাংলাদেশে লজিস্টিক্স চ্যালেঞ্জ বড় সমস্যা। এর সমাধান:

  • সাপ্লায়ারদের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গড়ে তুলুন
  • ভৌগলিকভাবে কাছাকাছি সাপ্লায়ার বেছে নিন
  • বাফার স্টক সঠিকভাবে নির্ধারণ করুন

TPS বাস্তবায়নের সফলতার গল্প: বাংলাদেশী প্রেক্ষাপট

ঢাকার একটি মোটরসাইকেল পার্টস কারখানায় TPS বাস্তবায়নের পর ফলাফল:

  • উৎপাদন সময় 40% কমেছে
  • পণ্যের গুণমান ত্রুটি 60% কমেছে
  • কর্মী সন্তুষ্টি 25% বেড়েছে
  • ইনভেনটরি 50% কমেছে

এই সফলতার পেছনে ছিল কর্মীদের প্রশিক্ষণ, ম্যানেজমেন্টের প্রতিশ্রুতি, এবং ধৈর্য সহকারে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন।

উপসংহার

টয়োটা প্রডাকশন সিস্টেম হল একটি যাত্রা, একটি গন্তব্য নয়। এটি বাংলাদেশের কারখানায় বাস্তবায়ন করতে সময় ও ধৈর্য লাগবে। তবে ফলাফল অবশ্যই এই প্রচেষ্টার যোগ্য! ছোট পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করুন, সফলতা উদযাপন করুন, এবং নিরন্তর উন্নয়নের মনোভাব গড়ে তুলুন।

মনে রাখবেন, TPS শুধু একটি উৎপাদন পদ্ধতি নয়, এটি একটি দর্শন যা আপনার ব্যবসায়ের সংস্কৃতিকে বদলে দিতে পারে। আপনি যদি আপনার কারখানায় TPS বাস্তবায়ন করেন, তাহলে আমাদের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন।

অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য!


লেখক সম্পর্কে: লেখক বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি টয়োটা প্রডাকশন সিস্টেম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায় এটি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *